খুৎবা (খতীব হল যে খুৎবা দেয়)একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ভাষণ। সাধারণত জুমার নামাজ ও দুই ঈদের নামাযের পূর্বে ইমাম সাহেবের বক্তব্যকেই আরবিতে খুতবা বলা হয়। খুতবায় সাধারণত ইসলামিক আঙ্গিকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বা আগত বিভিন্ন বিষয়গুলি ইসলামের দৃষ্টিতে কেমন তা আগে থেকে মুসলমানদেরকে জানিয়ে দেওয়া জুমার সালাতের মাধ্যমে। এক কথায় বলা যায় খুতবা হল মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈমানী আপডেট।
খুতবায় সাধারণত মুসলমানরা ব্যক্তিগত,পারিবারিক রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল অধ্যায় নিয়ে আলোচনা হবে এবং করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে অবগত হবে। যার কারণে জুমার খুতবা আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। অথচ আজ মসজিদের খুতবা গুলোর মধ্যে কোন আবেদন থাকেনা। মুসল্লিরা ভ্রু কুঁচকে থাকে কখন শেষ হবে? শেষ হচ্ছে না কেন? এসবের পেছনে আসলে কারণ কি?
অনেক কারণ থাকতে পারে।তবে আমরা আজ উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করব যেসব বিষয় নবীজির খুতবায় ছিল আর আমাদের খুতবায় হারিয়ে গেছে। সে হারিয়ে যাওয়া সুন্নতগুলো প্রয়োগ করলে আমাদের খুতবা হয়ে উঠবে আরো প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয়।সুখী-সমৃদ্ধ ও ঈমানদার জাতি গঠনে খুতবা হয়ে উঠবে খুবই কার্যকরী একটি উপাদান।
উপস্থাপনায় সুন্নাহ
খুতবার উপস্থাপনাটা খুব জরুরি একটা বিষয়। আমাদের খুতবা গুলি সমাজ পরিবর্তনে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারে না।অথচ রাসূল এর খুতবা প্রেজেন্টেশন বা উপস্থাপনার একটা চমৎকার ফরমেট ছিল। সাহাবায়ে কেরাম খুবই প্রভাবিত হতেন ও তাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। হতাশাগ্রস্ত বান্দারা নতুন আশার আলো খুঁজে পেত। অন্যদিকে ব্যর্থরা পেত উঠে দাঁড়ানোর প্রেরণা। বর্তমান সময়ে অনেক খতিবরা নিজেদের মতো করে মন্ত্রের মতো খুতবা বই দেখে পাঠ করতে থাকেন আর মুসুল্লিরা বাধ্য হয়ে নামাজের অপেক্ষায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচির হালতে শুনেন। এবার আসুন হাদিস থেকে দেখি নবীজির খুতবার ফরমেট কেমন ছিল।
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খুতবাহ্ (ভাষণ) দিতেন তাঁর দু’চোখ লাল হয়ে যেত, কণ্ঠস্বর হত সুউচ্চ, রাগ বেড়ে যেত। মনে হত তিনি কোন সামরিক বাহিনীকে এ বলে শত্রু হতে সতর্ক করে দিচ্ছেন।
সহীহ : মুসলিম ৮৬৭,
অথচ কুরআন সাক্ষ্য দিচ্ছে নবিজি কড়া মেজাজের ছিলেন না। বরং একদম নরম দিলের মানুষ ছিলেন। নবীজির নম্রতা’র ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত হয়েছে।
“আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন।
আল ইমরান – ১৫৯
অথচ এই নরম মানুষটা খুতবার সময় মুসল্লিদের সামনে এতটা উত্তেজিত হয়ে যেতেন কেন? যাতে করে খুতবা মুসল্লিদের হৃদয়ে প্রভাবিত করে। ফলে নবীজির খুতবা হয়ে উঠত এত বেশি প্রাণবন্ত যে সাহাবায়ে কেরাম এতটাই মনোযোগী হয়ে শুনতেন যে তাদের মাথার উপর পাখিরা বসে থাকার মতো অবস্থা হতো।
খতীবকে উম্মতের চাহিদা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে
একজন ডাক্তারের কাজ হচ্ছে, রোগীর জন্য রোগ নির্ধারণ; রোগ অনুযায়ী ঔষধ প্রয়োগ করা যাতে করে সে যথাসময় সুস্থ হয়ে যায়।ঠিক তেমনি ভাবে একজন খতিবের কাজ হচ্ছে তার মুসল্লিদের মধ্যে কোন বিষয়ের জানা ও মানার অভাব রয়েছে।সেই সমস্যা নির্ধারণ করে খুতবার মাধ্যমে মুসল্লিদের সামনে সমাধান তুলে ধরা।অনেকেই আছেন খুতবার বই দেখে গৎবাধা খুতবা দিতে থাকেন অথচ জাতির সামনে খুব প্রয়োজনীয় চলমান ইস্যু থাকে। সেই বিষয়ে তিনি কোন কথা বলেন না। বরং শুধুমাত্র খুতবার বইয়ে যা আছে তিনি সেই বিষয়টা প্রতি জুমায় পড়ে যান।
যার ফলে মুসল্লিদের সাথে খতিবের কোন ধরনের সংযোগ থাকে না।যা খুতবা বিরক্তিকর হয়ে ওঠার অন্যতম একটি কারণ। অথচ নবীজির খুতবার চিত্র দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে নবীজির ইমাম হিসেবে মুসল্লিদের একটা অদৃশ্য সংযোগ ছিল। তিনি এমনভাবে খুতবা দিতেন।মুসল্লীরা কোনভাবেই তাদের মনযোগ নবীজির কাছ থেকে ফেরাতে পারতেন না। খুতবা প্রদানের সময়েও মুসল্লিদের চাহিদা-আবেদনের প্রতি তিনি বিশেষভাবে খেয়াল করছেন। তিনি জরুরী পরিস্থিতিতে মুসল্লীদের অভিযোগ ও শুনতেন, এমনকি জুমুআর সময়ও এক ব্যক্তি খরার সময় বৃষ্টির জন্য দো‘আ করতে অনুরোধ করেছিল।এতে স্পষ্ট হয়ে যায় সেই সময়ের খুতবা সমাজে কেমন প্রভাব তৈরি করত।যা আমাদের সমাজে এখন তুলনামূলক খুব বিরল।
সময়-জ্ঞানের প্রতি অমনোযোগিতা
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যারা নেতৃত্বে থাকেন, জনগণের জন্য তাদের মধ্যে চিন্তার আবেদন যেন তৈরি হয় এমন প্র্যাকটিস শিখিয়েছেন। তিনি তাদেরকে দুর্বল, বয়স্ক এবং জরুরী প্রয়োজনে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বিষয় যেন বিশেষভাবে স্মরণ রাখে সেই নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন ।যার ফলে আমরা দেখি জামাতে নামাজে তিনি যদি একটি শিশুর কান্না শুনতে পেতেন। তবে তিনি তার নামাজকে সংক্ষিপ্ত করতেন।তাছাড়া আজকে আমাদের জুমার নামাজে অনেক লোক উপস্থিত থাকেন।যারা হয়তো কাজের বিরতিতে নামাজ পড়তে এসেছেন অথবা নামাজের পরে জরুরি কাজ রয়েছে।অনেক খতিব রয়েছেন তাদের কথা চিন্তাই করেন না।প্রায় এক ঘন্টা খুৎবা দেয়ার পরে মুসল্লি বিরক্ত হয়ে গেলেও খতিব সাহেবের বয়ানের তৃপ্তি মেটেনা। তিনি বলে উঠেন ” সময়ের অভাবে শেষ করতে পরোলাম না।বাকিটা আগামী খুৎবায় শেষ করব ইনশাআল্লাহ। সবাই নির্ধারিত সময়ের আগে আসবেন “।একথা শোনার পর মুসল্লিরা সিদ্ধান্ত নেয়। আগামী জুমায় নামাজের ৫ মিনিট আগে আসব। এভাবেই খুৎবাবিমুখী হয়ে উঠে সাধারণ মানুষ।ভদ্রতার খাতিরে মানুষ হয়তো কিছু বলেনা।তবে মনে মনে গভীরভাবে বিক্ষুব্ধ হয়। সময়-সুযোগ পেলে বিক্ষোভ প্রকাশ করে। আসুন একটি আয়াতকে মনোযোগ দিয়ে পড়ি।
“হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ করো। এটিই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি করো। নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’
-সূরা জুমা: ৯-১০
কোরআনের এই আয়াতে জুমার দিন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে জামাতে হাজির হওয়ার জন্য যেমন আদেশ রয়েছে। আবার নামায শেষ করার পরে উপার্জনের জন্য নিজের কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে বলা হয়েছে। এর মানে “ইসলাম” ধর্ম এবং জীবনকে আলাদা করে দেখে নাই। বরং নামাজ কে যেমন ইবাদত হিসেবে দেখেছে উপার্জন করাকে এবাদত হিসেবে চিত্রায়িত করেছে।একজন ইমাম-খতিবের নামাযের দৈর্ঘ্য এবং খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া সুন্নাহ-সচেতন ঈমানদারের পরিচায়ক।কারণ বিষয়টি সর্বকালের সেরা বিবেচক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নজর এড়ায়নি। তাই তিনি জুমার খতিবদের এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
সাহাবি হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তির নামাজ দীর্ঘ হওয়া আর খুতবা ছোট হওয়া তার বিচক্ষণ হওয়ার আলামত। সুতরাং তোমরা নামাজ দীর্ঘ করো আর খুতবা সংক্ষিপ্ত করো। “
এখানে নামাজ দীর্ঘায়িত করার অর্থ হলো- তুলনামূলকভাবে লম্বা করা। কারণ অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যারা নামাজে কেরাত লম্বা করে তাদেরকে তিনি ফেতনা সৃষ্টিকারী বলে শাসিয়েছেন। কথা আর দীর্ঘায়িত করবো না। প্রিয় খতিব সাহেব! এই কথাগুলো শুধু আমার নয় অসংখ্য মুসল্লির মনের না বলা কথা ও অব্যক্ত বেদনা।আপনাদেরকে লিখনীর মাধ্যমে জানালাম। আপনারা যদি এই বিষয়গুলো মাথায় রাখেন। তাহলে উম্মত যেমন উপকৃত হবে। খতিবের হক তেমন আদায় হবে।সমাজ হয়ে উঠবে ইনসাফ ও ন্যায়ের আলোয় আলোকিত।কুরআন এবং সুন্নাহর রঙে হয়ে উঠবে রঙিন।আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করেন, আমিন।
লিখেছেনঃ মাওলানা আবু আইমান, খতিব, আল্লামা জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ)